বর্তমান সময়ে একশান জনরা অনেকটা উপহাসের পর্যায়ে পড়ে গিয়েছে। নতুন কোন একশান মুভির ট্রেলার কিংবা ব্লুরে রিলিজ পেলে সবাই একরকম ধরেই নেয় বাজে অভিনয়, বাজে ডিরেক্টিং, সিজিআই এর অপব্যাবহার আর বড়জোর মিডিওকোর প্লটের কোন ডিসাস্টার হতে যাচ্ছে। এই চিন্তা ধারাকে চ্যালেঞ্জ করেই হয়ত জর্জ মিলার তার ম্যাড ম্যাক্স সিরিজের চতুর্থ কিস্তি ফিউরি রোড এর কাজ শুরু করেন। তাঁর পরিচালনায় ১৯৭৯ সালে মুক্তি পায় প্রথম ম্যাড ম্যাক্স মুভিটি যেটি দারুণ একটি রিভেঞ্জ মুভি। দু বছর পর ১৯৮১ সালে ম্যাড ম্যাক্সঃ রোড ওয়ারিয়র মুক্তি পায় যেটি মূলত পোস্ট এপোক্যালিপ্টিক একশান জনরার জন্ম দেয়। রোড ওয়ারিয়র মুক্তির পর সমালোচক ও দর্শক মহলে দারুণ সাড়া ফেলে দেয়। এখন পর্যন্ত মুভিটির ওয়াচেবিলিটি কমে নি বরং বর্তমান সময়ের অনেক একশান মুভিও ওই মুভির ধারে কাছে নেই। এই সিরিজের শেষ মুভি ম্যাড ম্যাক্সঃ বিয়ন্ড থান্ডারডোম এর মুক্তির প্রায় ৩০ বছর পর মুক্তি পেল এই মুভিটি। বর্তমান সময়ের রিসোর্স, মেগা বাজেট(১৫০ মিঃ ডলার) আর অসাধারণ স্টান্ট কোঅরডিনেটর এর সুবাদে তিনি ফিউরি রোডে যা করে দেখালেন তা চলচ্চিত্র ইতিহাসে একটি একশান ক্লাসিক হিসেবে যুগ যুগ ধরে স্মৃত হবে এটি নির্দ্বিধায় বলা যায়।
মুভির প্লট
একেবারেই সোজাসাপ্টা মনে হলেও এর ডেপথ বর্ণনা করতে গেলে আমার আর রিভিউ লিখা হবে না। অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীতে পারমাণবিক যুদ্ধ আর দুর্যোগে প্রকৃতি প্রায় বিলীন হওয়ার পথে। পুরো পৃথিবী যেন বিশাল এক মরুভূমি। মানুষ এবং পশুপাখি মিউটেটেড হয়ে তাদের আকৃতি এবং প্রকৃতিতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। এই অবস্থায় এলাকাভিত্তিক কিছু লর্ড যারা পানি আর জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ করে তারাই সেই এলাকার সর্বময় কর্তা। এমনি একজন “ইম্মরটান জো”। সে নিজেকে তার অসুসারিদের কাছে দেবতাতুল্য মনে করে। সে তাদেরকে নিয়ে একটা কাল্ট গঠন করেছে। এখানকার শিশু/বালকদের সে ছোটবেলা থেকেই নানা কুসংস্কার এর মাধ্যমে ব্রেইনওয়াশ করে যে তার সেবা এবং তার জন্য যুদ্ধে জীবন দান করলেই বাকী সময় তারা স্বর্গসুখ লাভ করবে! আর এরা যুবকে পরিণত হলে এদেরকে বলা হয় ওয়ারবয়। এদের অনেকেই নন মিউটেটেড ব্রিডারস (ওয়াইভস) দের সন্তান যাদেরকে ইম্মরটান জো বিভিন্ন যায়গা থেকে কিডন্যাপ করে নিজের স্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করে। সে এদেরকে নিজের প্রোপার্টি(থিংস) হিসেবে তার যা খুশি তাই করে। এদিকে ম্যাক্স রকাট্যান্সকি(টম হার্ডি) ইম্মরটান জো এর একটি স্কাউটের হাতে ধরা পড়ে। জো তাকে তার একজন অসুস্থ ওয়ারবয় নাক্স(নিকোলাস হল্ট) এর ব্লাড ব্যাগ হিসেবে ব্যাবহারের আদেশ দেয়। কিন্তু এদিকে ইম্পেরেটর ফিউরিওসা(শার্লিজ থেরন) ওয়াইভসদেরকে তাদের দুর্দশা থেকে মুক্তি দেবার জন্য জো এর সবচেয়ে শক্তিশালী ওয়াররিগ নিয়ে পালিয়ে যায়। এটি জানতে পেরে জো তার সব ওয়ারবয়দেরকে নিয়ে ফিউরিওসাকে তাড়া করতে শুরু করে।
মুভিটির প্রাধান স্টার হচ্ছেন জর্জ মিলার! পুরো মুভিতে তাঁর অসাধারণ পারদর্শিতা আর অভিজ্ঞতার ছাপ বিদ্যমান। মুভির প্রথম শট থেকে শুরু করে শেষ শটটি পর্যন্ত প্রত্যেকটা সিন যেন ক্যনভাসে আঁকা। ওয়াইড এঙ্গেল, থ্রি সিক্সটি, ট্র্যাকিং আর টপ ভিউ সিনেমাটোগ্রাফিতে মনে হচ্ছিল আমি এই ঘটনার একেবারে কেন্দ্রে বসে আছি। একটা জায়গায়ও আমি ক্যামারা শেকিনেস বুঝতে পারি নি। জর্জ মুভিটির সিনেমাটোগ্রাফির জন্য অস্কার উইনার জন সিল কে অবসর থেকে ফেরত আনেন! মুভিটা পুরোপুরই ফিজিকাল ইম্পেক্ট ফেলবে দর্শকের উপর যদি তিনি মুভিটি সিনেমাহলে দেখেন। প্রত্যেকটা একশান সিকোয়েন্স শেষে হাফ ছাড়ার আগেই আরেকটি একশান সিন শুরু হয়ে যাবে। মুভিটি রোড ওয়ারিয়রের এপোক্যালিপ্টিক চেইস স্টাইলে করা। ৯০% মুভিই রাস্তায়। তাই বলে এটা ভাবা ভুল যে এতে ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট এর ঘাটতি ছিল। প্রত্যেকটা ক্যারেক্টার সম্বন্ধে দর্শকে পরিষ্কার ধারণা হবে যদিওবা মুভিটিতে তেমন বেশি ডায়লগ নেই। ক্যারেক্টার গুলোর জন্য দর্শকের ভালবাসা আর ঘৃণা জন্মাবে এমনভাবে যে প্রত্যেকটা সিনে আপনি প্রার্থনা করবেন যেন কোন অঘটন না ঘটে কিংবা এই শয়তানটা যেন এখনই মারা যায়। অথচ মুভিটা প্রায় ডায়লগশুন্য। অনেকে এই স্টাইল কে “মিনিমালিস্ট” এপ্রোচ বলছেন যেটিতে ডায়লগ একেবারেই কম কিন্তু সিন ডিটেইলস অনেক বেশি। এব্যাপারে জর্জ মিলার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আরেকটা ব্যাপার যেটি আমি করতে চেয়েছি গল্পটি খুব অল্প ভাষায় বলতে। এটি এমন একটি পৃথিবী (পোস্ট এপোক্যালিপ্টিক) যেখানে মানুষ খুব কম কথা বলে। আর আমি একটা ব্যাপক পরিধির চেস দেখাতে চেয়েছি যেখানে দর্শক রাস্তাতেই ক্যারেক্টারদের সাথে পরিচিত হতে পারবে।” ব্যাপারটা একশান জনরায় একেবারে ফ্রেশ এপ্রোচ।
মুভিটির প্রধান প্রটাগনিস্ট হচ্ছে ফিউরিওসা। আর শার্লিজ থেরন এই ক্যারেক্টারটিতে পুরো ফাটিয়ে দিয়েছেন! চুল কাটেন, মুখে কালো দাগ লাগান আর যাই করেন না কেন তাঁর এট্রাক্টিভনেস এক ফোঁটাও কমে নি। তাঁর অভিনয়, মোটিভেশান আর একশান সবকিছুতেই পারফেকশন ছিল। ম্যাক্স এর সাথে টেক্কা দেয়ার মত শারীরিক এবং মানসিক শক্তি দুটোই ছিল ফিউরিওসার। তাঁর উদ্দেশ্য এই অসহায় মেয়েদেরকে নিরাপদ কোন স্থানে নিয়ে যাওয়া। এবং এটি করতে সে সব কিছুর মোকাবেলা করতে প্রস্তুত। মুভিটা দেখে মনে হবে এটা ফিউরিওসা ভার্সেস দ্যা ওয়ার্ল্ড। মুভির শুরু থেকেই তার বাম হাতে একটা ম্যাটালিক হাত লাগানো। যেটি ক্যারেক্টারটিকে আরও ব্যাডএস করে তোলে। শার্লিজ থেরন ক্যারেক্টারটিকে এত সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছে আমি এই ক্যারেক্টারে আর কাউকে এই মুহূর্তে চিন্তা করতে পারছি না। ম্যাড ম্যাক্স মুভিগুলো সব আলাদা আলাদা গল্প। একটার সাথে অন্যটার গল্পের রিলেশান নেই দুই একটা বিটস এন্ড পিসেস ছাড়া। তাই জানি না সামনের কোন মুভিতে ফিউরিওসাকে দেখতে পাব কিনা। কিন্তু আমি চাই তার অরিজিন কিংবা ফিউরিওসাকে নিয়ে কোন একটা আলাদা এপিসোড হোক।
ম্যাক্স রকাটান্সকি হিসেবে টম হার্ডি ভাল কাজ করেছেন তবে এখনও আমার প্রিয় ম্যাক্স মেল গিবসন। টম মুভির প্রায় প্রথম অর্ধেকে মুখে মাস্ক পরেই ছিল! পরবর্তীতে মাস্ক খোলা অবস্থায়ও খুব একটা ডায়লগ ছিল না। এর যথেষ্ট লজিকাল কারণও আছে। সে একজন লোনার। এই অবস্থায় সে বছরের পর বছর কথা না বলেও থাকে। আর যখন ম্যাক্স কথা বলছিল সেটি দারুণভাবে করেছে টম। ম্যাক্স সবসময় অন্য লোকজনের ঝামেলার মধ্যে নিজে জড়িয়ে যায়। এখানেও ঠিক তাই ঘটেছে। সে এই পরিস্থিতি থেকে নিজেকে কীভাবে উদ্ধার করবে সেটি পুরোপুরি নির্ভর করবে তার ইম্প্রোভাইজেশানের উপর। অন্যান্য ম্যাড ম্যাক্স মুভিতে ফিউরিওসা লেভেলের কোন ক্যারেক্টার না থাকাতে আমরা ম্যাড ম্যাক্স মুভি মূলত দেখেছি ওয়ান ম্যান শো হিসেবে। কিন্তু এই মুভিটি ব্যাতিক্রম। তাই পুরো মুভিতে ম্যাক্স এর রাজত্ব আশা করাটাও বোকামি। আগের ম্যাক্স এর স্ন্যাপি ডায়লগ গুলো মিস করেছি তবে এখানেও ম্যাক্স বেশ হিউমেরাস। সবকিছু মিলিয়ে টম হার্ডি বেশ ভাল কাজই করেছেন। আশা করছি পরের মুভিতে আরও ভাল করবেন।
নিকোলাস হল্টের নাক্স ক্যারেক্টারটি আমাকে বিস্মিত করে। আমি মোটেও এই ক্যারেক্টারকে এত বড় করে চিন্তা করে নি। নিকোলাস হল্ট নাক্স ক্যারেক্টারটিতে সিমপ্লি ফ্যান্টাস্টিক কাজ করেছে! ওকে দেখে তো একে চেনার উপায় নেই তার উপর সে পুরো ক্যারেক্টারটিতে হারিয়ে গেছে। হ্যাটস অফ। ইম্মরটান জো এর প্রতি তার ডেডিকেশন দেখে দর্শক বিস্মিত হতে বাধ্য।
আর ইম্মরটান জো ক্যারেক্টারটি করেন Hugh Keays-Byrne। মজার ব্যাপার হচ্ছে ফার্স্ট ম্যাড ম্যাক্স এর প্রধান ভিলেইন টো-কাটার ক্যারেক্টারটিও ইনিই করেন। যারা ম্যাড ম্যাক্স ১ দেখেছেন তারা তো জানেনই টো কাটার আর ইম্মরটান একই লোক না। হিউ দারুণ কাজ করেছেন এই মুভিতেও। আল্টিমেট ইভিল মাদার ডাকিং ক্যারেক্টারের রুপায়ন বলব তাকে। যে কিনা তার সবকিছুর বিনিময়ে হলেও তার ওয়াইভস দেরকে ফিরিয়ে আনবে!
আরেকটি ক্যারেক্টার যাকে নিয়ে কিছু না বললেই নয় সেটি হচ্ছে ডুফ ওয়ারিয়র!! এই মুভিতে মানুষের সভ্যতার আবার আদিকালের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার একটা আভাস আছে। যেমন স্পিয়ারের(মোডিফাইড) এর ব্যাবহার। এছাড়া আরেকটা বড় ইঙ্গিত হচ্ছে যুদ্ধে আগে যেমন বাদ্যযন্ত্রের প্রচুর ব্যাবহার হত সেটি। এই মুভিতে একটা বিশাল ট্রাক ডেডিকেটেড থাকে শুধুমাত্র এই ডুফ ওয়ারিয়র আর ড্রামারদের জন্য। ডুফ ওয়ারিয়র তার ইলেট্রিক গিটারে স্ট্রামিং করলেই আগুনের স্ফুলিংগ বের হয় এর মাথা থেকে। সিমপ্লি অসাধারণ একটা সংযুক্তি মুভিটিতে!
মুভির স্কোর ভাল তবে অসাধারণ লাগে নি। জাঙ্কি এক্স এল এর কাজে ক্রিয়েটিভিটি ছিল তবে কিছু কিছু একশান সিনে সাউন্ডটা ফিল করছিলাম না। এমনিতে সাইলেন্ট মোমেন্টগুলোতে সাউন্ডের ইন্টারাপশান থাকলে হয়ত খারাপ লাগত। তবে সাউন্ড আমার কাছে মনে হয়েছে আরও ভাল হতে পারত।
আমি একশান জনরার একজন হার্ড কোর ফ্যান। ৮০/৯০ দশকে একশান মুভিগুলোকে মানুষ সিরিয়াসলি নিত। এখন একশান মুভিগুলোকে কেউ সিরিয়াসলি নেয় না। কারণ একটাই একই প্লট, একই সিজিয়াই, একই একশান! ম্যাড ম্যাক্সঃ ফিউরি রোড একশান জনরার মুভি লাভারজদের জন্য একটা আশার সংকেত। জর্জ মিলারের কাছ থেকে যদি তরুণ ডিরেক্টাররা কিছু শেখেন! যারা ভাবেন যে প্র্যাক্টিকাল ইফেক্ট আর সিজিআই ইফেক্টের তেমন কোন তফাৎ নেই তাদের মুখ ম্যাড ম্যাক্সঃ ফিউরি রোড বন্ধ করে দিয়ছে। এটা হতে পারে প্র্যাক্টিকাল ইফেক্টের ব্যাবহারের একটা রেভুলুশন। প্র্যাক্টিকাল ইফেক্ট যেটি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে সেটি আবার আশার আলো দেখছে। কিছু কিছু সময়ে “লেস ইজ বেটার “। ম্যাড ম্যাক্স এর ডায়লগ আর গল্পের ক্ষেত্রে এই কথাটি প্রযোজ্য।
ম্যাড ম্যাক্স আমার কাছে এখন পর্যন্ত দেখা সেরা একশান মুভি, সেরা পোস্ট এপোক্যালিপ্টিক মুভি। আমি জানিনা এর সিকুয়েল কীভাবে এই মুভিকে টপকাবে। সে যাই হোক আমি চাই আরও অনেক ম্যাড ম্যাক্স আসুক। যতদিন জর্জ মিলার এই প্রোপার্টির সাথে এটাচড থাকবেন ততদিন আমার বিশ্বাস ম্যাড ম্যাক্স দেখে আমাদের নিরাশ হওয়ার সুযোগ নেই।
রিভিয়ার রেটিংঃ ৫/৫
Mad Max: Fury Road (2015) | |
---|---|
Rating: N/A/10 (N/A votes) Director: George Miller Writer: George Miller, Brendan McCarthy, Nick Lathouris Stars: Tom Hardy, Charlize Theron, Nicholas Hoult, Rosie Huntington-Whiteley Runtime: 120 min Rated: R Genre: Action, Adventure, Thriller Released: 15 May 2015 | |
Plot: In a stark desert landscape where humanity is broken, two rebels just might be able to restore order: Max, a man of action and of few words, and Furiosa, a woman of action who is looking to make it back to her childhood homeland. |
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন