বর্তমানে প্রযুক্তি বাজারে যে সকল স্মার্টফোন পাওয়া যাচ্ছে বা আগামীতে যেসকল ফোন বাজারে ছাড়ার চিন্তা ভাবনা চলছে সেই ডিভাইসগুলো এতটাই শক্তিশালী করে তৈরি করা হচ্ছে যেন একজন ব্যবহারকারীর আলাদা আলাদা কাজের জন্য মাল্টিপল ডিভাইস ব্যবহার করতে না হয়। চার পাঁচ বছর আগের কথাও যদি চিন্তা করেন তবে দেখবেন এমপিথ্রি প্লেয়ার, এমপি ফোর প্লেয়ার, ডিজিটাল ক্যামেরার অনেক বেশি চল ছিল। এখনও ক্ষেত্রে বিশেষে অনেকেই ডিজিটাল ক্যামেরা ব্যবহার করে থাকেন তবে কালের এবং অবশ্যই প্রযুক্তির বিবর্তনে এমপিথ্রি প্লেয়ার এবং এমপি ফোর প্লেয়ার বলতে গেলে প্রায় হারিয়েই গিয়েছে।
কেননা, এখন এসব বেসিক মাল্টিমিডিয়া উপভোগ করার জন্য আমাদের হাতের স্মার্টফোনটিই যথেষ্ট, এমনকি এখনকার স্মার্টফোনগুলোই বরং সেসময়ের ডেডিকেটেড ভিডিও প্লেয়ারের চাইতে বেশি সুবিধা প্রদান করে থাকে। আবার আগে খেয়াল করলে দেখা যেত অনেকেই ডিজিটাল ক্যামেরা কিনছেন ছবি তোলার জন্য, আর এখন কেউ মিড রেঞ্জ বা হাই এন্ড ডিভাইস কেনার সময় আগে থেকেই ভেবে রাখেন যে সেই ডিভাইসটির ক্যামেরা যেন ভালো হয় যাতে করে ছবি তোলার কাজটিও এই এক স্মার্টফোন দিয়েই সেরে ফেলা যায়। শুধু যে এসব টুকি টাকি হ্যান্ডি গ্যাজেটের ব্যবহার কমেছে তা কিন্তু নয়, বেশ কিছু ক্ষেত্রে অনেকেই এখন ল্যাপটপের অনেক কাজও স্মার্টফোন বা ট্যাবে সেরে নেন। হ্যাঁ, এটা অবশ্যই সম্ভব নয় (হয়তো কোন কালে সম্ভব হয়েও যেতে পারে!) ল্যাপটপ বা ডেস্কটপের ব্যবহার পুরোপুরি বাদ দেয়া তবে অনেকেই কিন্তু (আপনি, আমিও!) খুব বেশি প্রয়োজন না হলে হাতের স্মার্টফোনটি দিয়েই কাজ চালিয়ে দিচ্ছেন।
এত কথা লিখে আসলে আমি একটি পয়েন্টের দিকেই আঙ্গুল তুলছি এবং তা হচ্ছে মানুষের সব কাজ এখন অনেকটা একটি ডিভাইসের মধ্যেই ঘটে যাচ্ছে এবং তা হচ্ছে আমাদের হাতের সাধের স্মার্টফোনটি। আর যখন আমরা এতগুলো ডিভাইসের কাজ একটি ডিভাইসে করছি তাতে স্বাভাবিক ভাবেই ডিভাইসের স্টোরেজেও আমাদের কিছুটা বেশিই লাগবে, নয় কি? এখনকার স্মার্টফোনগুলো অবশ্য অনবোর্ড ১২৮ গিগাবাইট পর্যন্ত বিল্ট ইন স্টোরেজ সুবিধা প্রদান করে থাকে তবে ৬৪ এবং ১২৮ গিগাবাইটের অনেক ফ্লাগশিপ ডিভাইসেই আবার দেখা যায় মেমোরি কার্ড এক্সপ্যানশন স্লট থাকেনা। তবে, ৬৪ অথবা ১২৮ গিগাবাইটে সমস্যা না হলেও ব্যবহারকারীরা একটি সেপারেট কার্ড ব্যবহার করতে পছন্দ করেন আর এর ফলেই যে স্মার্টফোনগুলোতে এক্সটারনাল মেমোরি কার্ডের অপশন রাখা হয়নি সেগুলোর ড্র-ব্যাকের লিস্টে এই ব্যাপারটি ব্যবহারকারীরা তুলে ধরেছেন।
যাই হোক, আমরা যখন একটি নতুন স্মার্টফোন কিনি এরপর কিন্তু মাথায় চিন্তা আসে একটি ভালো মেমরি কার্ড কেনার। যাতে করে আমরা নিজেদের মত করে ইচ্ছেমত ফাইল আমাদের প্রিয় স্মার্টফোনটিতে সংরক্ষণ করে যেকোনো সময় ইনস্ট্যান্ট এক্সেস করতে পারি। আর সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, আমরা স্মার্টফোন কেনার সময় অনেক মাথা খাটালেও মেমরি কার্ডের বেলাতে গিয়ে আমরা ফুস করে ‘এই ভাই, ১৬ গিগা কত আর ৩২ গিগা কত বলে দামাদামি করে কিনে ফেল!’ হ্যাঁ, কিছু ব্যতিক্রম আছেই, অনেকেই মেমরি কার্ডের মধ্যেও যে কিছু বোঝার বিষয় আছে সেগুলো জানেন। তবে, আমাদের দেশে এখনও হয়তোবা বেশিরভাগ ব্যবহারকারীই এই বিষয়গুলো সম্পর্কে অবগত নন। আর তাই আজকের এই ব্লগটি লেখা! আজকে আমরা মেমরি কার্ডের কিছু খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো যাতে করে এরপর আপনার আপনার বাজেটের মধ্যে পারফেক্ট মেমরি কার্ডটি দোকান থেকে কিনে আনতে পারেন।
আপনার কাছে যদি এখন একটি মেমরি কার্ড (মাইক্রো এসডি, বা অন্য কোন মেমরি হলেও চলবে) থেকে থাকে তবে লক্ষ্য করলে দেখবেন যে মেমরি কার্ডের সাথে এর ব্র্যান্ড এবং স্টোরেজ স্পেস ছাড়াও ছোট ছোট করে কিছু কথা লেখা থাকে, এগুলোও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশন যার মাধ্যমে সহজেই আমরা বুঝতে পারবো কোন মেমরি কার্ডটি ভালো এবং কোনটি অপেক্ষাকৃত আরও বেশি ভালো। নিচে আমি একটি ইমেজ যোগ করলাম, ইমেজটি অ্যামাজন থেকে নেয়া। অ্যামাজন থেকে যদি আপনি মেমরি কার্ড কিনতে চান তবে আপনি সেই কার্ডের উপরে থাকা তথ্য গুলোই কিন্তু প্রোডাক্টের ডেসক্রিপশনে দেখতে পাবেন। যাই হোক, মনোযোগ দিয়ে কার্ডটি খেয়াল করুন।
1
ভালো মাইক্রো এসডি কার্ড কি ফোনের স্পিড বুস্ট করতে সক্ষম?
এটা একটা কমন এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যে একটি ভালো মেমরি কার্ড কি আপনার স্মার্টফোনের পারফর্মেন্সে কিছুটা হলেও আলাদা গতি যোগ করতে সক্ষম কি না, এবং এর সংক্ষেপে উত্তর হচ্ছে, ‘অবশ্যই!’ কীভাবে? ব্যাখ্যা করছি!
আপনি আপনার মেমরি কার্ডে নিশ্চয়ই অ্যাপলিকেশন, ইমেজ, ভিডিও ইত্যাদি ডাটা রেখে থাকেন? ধরুন, আপনি আপনার মেমরি কার্ডে ১০০ টি ভিডিও রেখেছেন, তাহলে আপনি যদি একটি ফাস্টার হাই স্পিড মেমরি কার্ড ব্যবহার করে থাকেন তবে সেই মেমরি কার্ড থেকে সেই ফাইলগুলো রিডও হবে অনেক দ্রুত। আপনি যদি সেখান থেকে ফাইলগুলো কোথাও মুভ বা কপি করতে চান তবে তা অনেক বেশি দ্রুত কপি হবে (ক্লাসের উপর নির্ভর করে)। আবার ধরুন, আপনার মেমরি কার্ডে আপনি কিছু গেম বা অ্যাপলিকেশন ইন্সটল করে রেখেছেন। তাহলে প্রতিবার যখন আপনি আপনার অ্যাপটি বা গেমটি রান করবেন তবে তা খুবই দ্রুত রান হয়ে যাবে। এই পার্থক্যগুলো সহজেই আপনি একটি স্লো মেমরি কার্ড এবং ফাস্ট হাই স্পিড মেমরি কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে ধরতে পারবেন। তবে আপনি যদি আপনার স্মার্টফোনের বিল্ট ইন স্টোরেজের সাথে তুলনা করতে যান তবে তাতে এক্সটারনাল মেমরি কার্ড কিছুটা পিছিয়ে পড়বে কেননা ফোন এবং মাইক্রো এসডি কার্ডের মধ্যে একটি এক্সট্রা কমিউনিকেশন লেয়ার কাজ করে যা সরাসরি ফোন এবং বিল্ট ইন স্টোরেজের মধ্যে থাকেনা।
SDHS এবং মাইক্রো SDXC এর মধ্যে পার্থক্য কী?
যখন আপনি একটি মাইক্রো এসডি কার্ড কিনবেন তখন একটি লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন যে কার্ডটির উপরে হয় মাইক্রো SDXC লেখা আছে অথবা SDHC লেখা আছে। এই SDXC এবং SDHC হচ্ছে দুটি মাইক্রো এসডি কার্ডের দুটি আলাদা ফরম্যাট যার মাধ্যমে মূলত সেই মেমরি কার্ডটি ঠিক কোন অ্যামাউন্টের ডাটা স্টোর করতে সক্ষম তা বুঝিয়ে থাকে। SDHC এর পূর্ণ রূপ হচ্ছে Secure Digital High Capacity যা ৩২ গিগাবাইট পর্যন্ত ডাটা স্টোর করতে সক্ষম এবং SGXC এর পূর্ণ রূপ অচ্ছে Secure Digital Extended Capacity যা ৬৪ গিগাবাইট এবং এর উপরে ডাটা স্টোর করতে সক্ষম।
2
উপরের ছবিটিতে আপনার দেখতে পাচ্ছেন একটি স্যানডিস্ক ব্র্যান্ডের ২০০ গিগাবাইট মাইক্রো SDXC I কার্ড যার ক্লাস হচ্ছে ১০। স্যানডিস্ক এবছরের মার্চ মাসে এই মেমরি কার্ডটি প্রযুক্তি বাজারে রিলিজ করে। খেয়াল করে দেখুন গোল দাগের মাঝে ১০ লেখা রয়েছে, অর্থ – মেমরি কার্ডটি ক্লাস ১০ এর, ক্লাস সম্পর্কে এখনও বলিনি আপদের। বলছি একটু পর! এছাড়াও পাশে লেখা আছে I, এর অর্থ এটি UHS-1 কম্প্যাটিবল। UHS – বিষয়ে আমি একটু পরেই আলোচনা করবো।
বেশির ভাগ লো এবং মিড রেঞ্জের ডিভাইসগুলোই SDXC ফরম্যাটটি সাপোর্ট করেনা তাই মেমরি কার্ড কেনার পূর্বে আপনার স্মার্টফোন ঠিক কি সাপোর্ট করে তা জেনে নেয়াটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
‘ক্লাস’ সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জেনে নেয়া যাক
এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় এবং খুব সহজও। মাইক্রো এসডি কার্ডগুলো বাজারে পাওয়া যায় মূলত ক্লাস ২, ৪, ৬, ৮ এবং ১০ এর। এই সংখ্যা গুলো মূলত বুঝায় মেমরি কার্ডটির ডাটা ট্রান্সফারের মিনিমাম রেট কত হতে পারে। হিসেব মতে, ক্লাস ২ এর একটি মেমরি কার্ডের সর্বনিম্ন রিড এবং রাইট স্পিড হবে 2 MB/s, এবং একই ভাবে ক্লাস ১০ এর একটি মেমরি কার্ডের ক্ষেত্রে এর সর্বনিম্ন রিড এবং রাইট স্পিড হবে 10MB/s, সহজ তাই না?
UHS কি?
২০০৯ থেকে তৈরি কিছু কিছু মেমরি কার্ডগুলো UHS-1 অথবা UHS-3 কম্প্যাটিবল। যেখানে খাতা কলমের হিসেব অনুযায়ী UHS কম্প্যাটিবল কার্ডগুলো 312 MB/s রেটে ডাটা ট্রান্সফার করতে সক্ষম তবে আমাদের এখন শুধুমাত্র এর সর্বনিম্ন ট্র্যান্সফার রেটেই আটকে থাকতে হচ্ছে কেননা এখন পর্যন্ত কোন স্মার্টফোনই UHS স্ট্যান্ডার্ড সাপোর্ট করেনা। আর UHS – 1 এবং UHS – 3 এর জন্য সর্বনিম্ন ট্র্যান্সফার রেট যথাক্রমে 10 MB/s এবং 30 MB/s।
শেষ কথা:
আমরা আজকে মেমরি কার্ড রিলেটেড যে বিষয়গুলো আমাদের জানা প্রয়োজন সেগুলো সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করলাম। আমাদের দেশের বাজারে প্রায় সব রকমের ব্র্যান্ডের মেমরি কার্ডই পাওয়া যায়। আর আজকের আলোচনা থেকে অন্তত এটুকু তো বুঝতেই পারছেন যে মেমরি কার্ড কেনা বিষয়টা দোকানে গিয়ে ‘মামা, মেমরি কার্ড দেন!’ -এর মত এত সিম্পল নয়, কিছু ব্যাপার দেখে শুনেই কেনা উচিৎ। আর আমার মতে মেমরি কার্ডের জন্য কিছু রেপ্যুটেড ব্র্যান্ড রয়েছে যেমন স্যানডিস্ক, স্যামসাং, কিংস্টোন – এগুলো চমৎকার সার্ভিস দিয়ে থাকে। স্যামসাং মেমরি কার্ডগুলো আমরা যেগুলো আমাদের দেশের লোকাল মার্কেট থেকে কিনে থাকি সেগুলো কিন্তু নকল। কেনার সময় দাম দেখেও কিন্তু আপনি কোয়ালিটি কিছুটা হলেও বুঝে নিতে পারবেন।
কেননা, একটি ৩২ গিগাবাইটের স্যানডিস্ক যদি ১৪০০ টাকার মত হয় তবে স্যামসাং কীভাবে আপনাকে ৭০০-৮০০ টাকায় একই স্টোরেজের মেমরি কার্ড প্রোভাইড করবে? তাই সস্তা কিনে দোকানে দাঁড়িয়ে জিতলেও কিন্তু লং রানে ধরা আপনিই খাবেন। সব শেষে বলবো, শখের মোবাইলে ভালো একটি মেমরি কার্ড ব্যবহার করুন। ভালো ফলাফল পাবেন।